দিন-রাতের আবর্তন মহান আল্লাহ তায়ালার কুদরতের নিদর্শন। দিন-রাতের অব্যাহত গতিময়তা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য বিরাট অনুগ্রহ। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তিনি এমন সত্তা, যিনি রাত ও দিনকে একে অন্যের পশ্চাতে আগমনকারী বানিয়েছেন সেই ব্যক্তির জন্য, যে বুঝতে চায় অথবা শোকর আদায় করার ইচ্ছা করে।’ (সূরা ফুরকান, আয়াত : ৬২)। আরবি মাসগুলোর মধ্যে রবিউল আউয়াল মাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ মাসটি মানব ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের স্মারক। এ মাসেই সাইয়্যেদুল মুরসালিন, খাতামুন নাবিয়্যিন হজরত মুহাম্মদ সা: এ ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেন, আবার এ মাসেই তিনি তাঁর ওপর অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব পালন শেষে নিজ প্রভুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন এবং মহান আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে গমন করেন। এ মাসেই তিনি মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন। সুতরাং এক দিকে এ মাসে রাসূল সা:-এর শুভাগমন বিশ্ববাসীকে পুলকিত করে, অন্য দিকে এ মাসে তাঁর প্রস্থান মুসলিম বিশ্বকে শোকাভিভূত করে। তাই এ মাসটি একই সাথে শোক ও আনন্দের। সে কারণেই এ মাসের আলাদা একটি মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে অন্যান্য মাসের ওপর। রবিউল আউয়াল অর্থ প্রথম বসন্ত। বসন্তের আগমনে যেমন গাছের পুরনো পাতা ঝরে গিয়ে নতুন পাতার মাধ্যমে গাছ নতুন করে সজীবতা লাভ করে, অনুরূপ বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা:-এর আগমনে অতীতের পয়গম্বরদের শরিয়ত রহিত হয়ে মুহাম্মদ সা:-এর ইসলাম নামক শরিয়ত সঞ্জীবিত ও পূর্ণতা লাভ করে। এ মাসের ফজিলত অপরিসীম। কোনো কোনো হাদিসে রবিউল আউয়ালের প্রথম দিন রোজা রাখার বিশেষ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে করিম সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি এ মাসের প্রথম তারিখে রোজা রাখবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে পূর্ণ বছর রোজা রাখার সওয়াব দান করবেন।’ তা ছাড়া, এ মাসে রাসূলের ওপর দরুদ পড়ার গুরুত্বও অনেক। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলে করিম সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আমি তার ওপর ১০০ বার দরুদ পাঠ করব।’ এ ছাড়াও এ মাসে প্রতিদিন গোসল করা, অধিক পরিমাণে নফল নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা ও অন্যান্য নফল ইবাদত করার ফজিলতও বর্ণিত হয়েছে। তবে হাদিসগুলোর সনদের মান দুর্বল। সামাজিক ও ঐতিহ্যগত কারণেও এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিম উম্মাহর জন্য ঘটনা-দুর্ঘটনার স্মৃতির সাথে বিজড়িত এ মাস। উম্মাহর বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম এই মাসের গুরুত্ব বিবেচনায় রমজানুল মোবারকের ওপরও এ মাসকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। কেননা রমজানুল মোবারকে কুরআন নাজিল হওয়ার কারণে শ্রেষ্ঠ হলেও যার ওপর কুরআন নাজিল হয়েছে, সেই মহান ব্যক্তির আগমন হয় এ মাসে। সে কারণে এ মাসের ফজিলত অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি। মাহে রবিউল আউয়াল জগৎবাসীর কাছে, বিশেষত মুসলিম উম্মাহর কাছে নববী আদর্শের তথা আত্মশুদ্ধি ও সমাজ সংস্কারের পয়গাম নিয়ে আসে। এ পয়গাম বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা ভূখণ্ডের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং সার্বজনীন। নবীজী সা:-এর আগমন ঘটেছিল এমন এক সময়ে, যখন পুরো আরব জাতি হত্যা, রাহাজানি, বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা- সব কিছু মিলিয়ে আইয়ামে জাহেলিয়াত তথা অন্ধকার যুগে বসবাস করছিল। ঠিক সে সময়ে বিশ্ববাসীর মুক্তির দূত হিসেবে আগমন করেন দোজাহানের সরদার মুহাম্মদ সা:। মারামারি, হানাহানির এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহ তায়ালা রাসূলে করিম সা:কে পাঠিয়েছেন বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সারা বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। রাসূলুল্লাহ সা: ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেন এবং ৬৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মাত্র ২৩ বছরের কর্মসাধনায় তিনি সমাজ ও দেশের এমন পরিবর্তন সাধন করেন, যা মানব ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। সমাজে মনুষ্যত্ব নির্মাণের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। দীর্ঘ ২৩ বছর পর আবার এই রবিউল আউয়াল মাসেই প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান তিনি। রবিউল আউয়ালের কোনো একদিন রাসূল সা:-এর শরীরের উত্তাপ বেড়ে যায়। সাথে সাথে কষ্টও বৃদ্ধি পায়। একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সামান্য স্বস্তিবোধ হলে তিনি মাথায় পট্টি বেঁধে মিম্বারে আরোহণ করেন। সমবেত সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ইহুদি-নাসারাদের ওপর আল্লাহ তায়ালার লানত। তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে।’ (বুখারি শরিফ)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা আমার কবরকে পূজা করার উদ্দেশ্যে মূর্তিতে পরিণত করো না।’ (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)। এরপর রাসূল সা: বলেন, ‘আমি যদি কাউকে আঘাত করে থাকি তাহলে সে আমার পিঠে চাবুক মেরে প্রতিশোধ গ্রহণ করুক।’ এই বলে তিনি নিজের পিঠ উন্মোচন করে দিলেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমাকে এক টুকরো কাগজ এনে দাও, আমি তোমাদেরকে কিছু উপদেশ লিখে দিই। তাহলে তোমরা গোমরাহ হবে না।’ পরবর্তীকালে হজরত উমর রা:-এর অনুরোধে হুজুর সা: তা লিখলেন না। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)। এ মাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাসূলুল্লাহ সা:কে ভালোবাসা। রাসূলের ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। হাদিস শরিফে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পযন্ত পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে আমাকে তার বাবা-মা, ছেলে-সন্তান ও সব মানুষ থেকে অধিক ভালো না বাসবে।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ১১/২০০)। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের মুসলিম সমাজে কিছু লোক বিশেষ করে মাজারপন্থীরা রাসূলের ভালোবাসার নামে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে, লাল কালি দিয়ে ‘বিশ্ব আশেকে রাসূল’ লিখে দেয়াল লালে লাল করে ফেললেও রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনাদর্শ ও সুন্নতকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে না। রবিউল আউয়াল এলেই তারা ঈদে মিলাদুন্নবী, জসনে জুলুসের নামে নারী-পুরুষের সম্মিলিত বর্ণাঢ্য র্যালি, আনন্দ মিছিল ও শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে রাসূলের জন্মদিনকে শ্রেষ্ঠ ঈদ ঘোষণা করে এবং নিজেদের আশেকে রাসূল দাবি করে থাকে। বস্তুত এসব কাজ অযৌক্তিক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, যার কোনো শরয়ী ভিত্তি নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাসূলের ভালোবাসা শুধু রবিউল আউয়াল মাসে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়; বরং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিমুহূর্তে, প্রতিক্ষণে সিরাত চর্চা করা, তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করা ও তাঁর জীবনাদর্শকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা উচিত। তবেই প্রমাণিত হবে আমরা আশেকে রাসূল এবং রক্ষিত হবে রবিউল আউয়াল মাসের মর্যাদা।
বিসিআই ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট এর পক্ষ থেকে সকলকে জানাই ঈদ ই মিলাদুন্নবীর শুভেচ্ছা